নঈম নিজাম :ছোট্ট একটা সার্জারি হলো আমার শরীরে। চিকিৎসক আগে থেকে কিছু বললেন না। কিছু জানা-বোঝার আগেই সার্জারি শেষ। দুই দিনের জন্য একটা কাজে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড। সঙ্গে ফরিদা ও আমার মেয়ে। বুধবার সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম মেয়েকে। ফরিদা মেয়েকে নিয়ে প্রবেশ করলেন চিকিৎসকের কক্ষে। ফাঁকে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুদিন থেকে বুকে ব্যথা অনুভব করছিলাম। বন্ধুদের অনেককে হারিয়েছি। ভয়ে ভয়ে চিকিৎসকের কক্ষে ঢুকলাম। মেডিসিন নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক বললেন, হৃদরোগ নয়, তোমার দেখানো দরকার আগে গ্যাস্ট্রিক, আলসার বিশেষজ্ঞ। ডাইজেস্ট বিভাগে যাও। গেলাম। একজন বয়স্ক লেডি ডাক্তার বসে আছেন। আমার কথা শুনলেন। বললেন, তোমার এনডোস্কপি ও কোলনোস্কপি করানো উচিত। সেই সঙ্গে আলট্রাসনো। কোলনোস্কপি ক্যান্সার শনাক্তের পরীক্ষা। অনেক কষ্টকর। বললাম, বাকি দুটো করি। কোলনোস্কপি পরে করব। ভদ্রমহিলা বিরক্ত হলেন। তারপর মন খারাপ করে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তোমার এটা করানো দরকার। এরপর যেখানে খুশি করিয়ে নিও। আপাতত রক্ষাতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটা রুমে। জামাকাপড় পরিবর্তন করে হাসপাতালের পোশাক পরলাম। একাকী বসানো হলো একটা কক্ষে। আলট্রাসনো করানো হলো শুরুতে। আলট্রাসনোর রিপোর্ট ডাক্তার দেখার আগেই নার্সেরা বললেন, তেমন সমস্যা নেই। তবে ভয়াবহ ফ্যাটি লিভার। তোমার সতর্ক হতে হবে। চিকিৎসক নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলবেন। বিষয়টি উৎকণ্ঠার। বললাম, ছোটবেলা থেকে বেশি ভাত খেয়ে আমরা অভ্যস্ত। ভাত-মাছ খেয়ে ফ্যাটি লিভার বানিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা শেষ করে ফিরে এলাম আগের রুমে। লকার খুলে ফোন নিলাম। ফোনে মেয়েকে সর্বশেষ জানালাম। এনডোস্কপি করতে সময় লাগবে। তিন ঘণ্টা পর ওদের আসতে বললাম। একজন নার্সের কাছে জানতে চাইলাম এনডোস্কপি কখন হবে? বললেন, বিকাল ৪টায় শুরু হবে। তার আগেই তোমাকে নিয়ে যাব সংশ্লিষ্ট রুমে। তোমাকে যিনি দেখেছেন, সেই চিকিৎসকও আসবেন। চিকিৎসক নিজে দেখবেন গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা না অন্য কিছু। সমস্যা থাকলে দেখবেন ও সিদ্ধান্ত দেবেন। সাড়ে ৩টার দিকে আমাকে অপারেশন রুমে নিয়ে গেলেন নার্সেরা। বেডে শুয়ে পড়তে বললেন। তারপর বললেন, হাঁ কর। মুহূর্তে মুখের ভিতর কিছু স্প্রে করলেন দুবার। বুঝতে পারলাম না কী করছেন। তাই বললাম, সকাল থেকে না খেয়ে আছি। ক্লান্তি ভর করেছে। তোমাদের এ স্প্রে ভীষণ তেতো। জবাবে তারা বললেন, গিলে ফেল পুরোটা। তা-ই করলাম। হঠাৎ শরীরে অবশ অনুভব করলাম। ঘুম নেমে আসছে দুই চোখজুড়ে। তারা নাকে অক্সিজেনের দুটো নল দিলেন। বুঝতে পারলাম না, কেন অক্সিজেন দিচ্ছেন। তখনো সেন্স আছে। তাই বললাম, আমার শ্বাস নিতে সমস্যা নেই। জবাবে তারা কোনো উত্তর দিলেন না। আমার মুখে একটা নল এনে রাখলেন। তারপর কিছু মনে নেই। তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
আমার ঘুম ভাঙল অথবা জ্ঞান ফিরে এলো সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। মাঝে জীবন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা চলে গেল টের পেলাম না। নার্সেরা বললেন, তুমি কি স্বাভাবিক মনে করছ নিজেকে? খারাপ অনুভব করলে আজ রাতে হাসপাতালে থাকতে হবে। হাসপাতাল আমার কাছে এক ধরনের ভীতির। আমার কী হয়েছে বুঝতেও পারছি না। শরীর একটু দুর্বল অনুভব করছিলাম। আগের মতো বল পাচ্ছিলাম না। মনে করলাম, এনডোস্কপি করার কারণে এমন হয়েছে কি না। ধীরে ধীরে বললাম, হোটেলে ফিরে যাব। আমি ঠিক আছি। কোনো সমস্যা নেই। চোখে ঘুম ঘুম ভাব লেগে আছে। তারা আমাকে ধরে নিয়ে আগের রুমটিতে বসালেন। জানতে চাইলাম, আমি কি তাদের ড্রেস বদল করতে পারি? জবাবে তারা বললেন, পারো। ফোন ব্যবহার করতে পারব কি না জানতে চাইলাম। বললেন, কোনো সমস্যা নেই। ফোন করতে পারো। পোশাক বদল করে ফোন করলাম মেয়েকে। কিছুক্ষণ পর ফরিদা ও আমার মেয়ে নূজহাত ভিতরে এলেন। চিকিৎসক এলেন। তিনি বললেন, তোমার ছোট্ট একটা অপারেশন করেছি। তুমি কি বুঝতে পেরেছ? মাথা নাড়লাম, পারিনি। শরীর ভালো লাগছিল না। তাই বললাম, তুমি অকারণে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছ কেন? সেই সকাল থেকে বসে আছি না খেয়ে। মাঝখানে চার ঘণ্টার কথা তখন আমার মনে নেই। চিকিৎসক এবার বললেন, আমিও তোমার জন্য বসে আছি। আমার চলে যাওয়ার কথা অনেক আগে। এতক্ষণ তোমার জন্য থাকতে হয়েছে। তোমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। কাল আরও কিছু পরীক্ষার পর ওষুধ দেব। জবাবে বললাম, কাল আসতে পারব না। আজকের মতো ওষুধ দিয়ে দাও। চিকিৎসক বললেন, ঠিক আছে। তুমি তিন মাস পর আবার ফলোআপ করবে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। তিনি বললেন, ওষুধ দিয়েছি। নিয়ে নিও। তিন মাস টানা খাবে। আর মনে রাখবে তোমার ফ্যাটি লিভার। অবস্থা ভালো নয়। ভাত খাবে না। কোক, সেভেনআপসহ সব ড্রিঙ্ক বন্ধ। সাবধানে থাকতে হবে। জানতে চাইলাম, কী সার্জারি করলে আমার? অনুমতি নিলে না? জবাবে বললেন, তোমার তখন জ্ঞান ছিল না। এনডোস্কপি করার সময় ধরা পড়ল তোমার স্টমাকের একটা সমস্যা। অপারেশন করে ফেলে দিতে হয়েছে ওটা স্টমাক থেকে। চিকিৎসকের কাজ সমস্যার সমাধান করা। আমি তা করেছি। অনুমতি আমার কাছে আসার সময় দিয়ে দিয়েছ। এখন সতর্ক থাকবে। নিয়ম মেনে চলবে। নির্ধারিত সময়ে খাবার ও ওষুধ খাবে। শরীর নিয়ে কোনো ডান-বাম করা চলবে না। মনে থাকবে তো?
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে হোটেলে ফিরলাম। সারা দিন খাওয়া হয়নি। রাতের ডিনার সারলাম। বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে। ঢাকায় ফেরার তাড়া আছে। চিকিৎসক অনুরোধ করেছেন, আরও একবার দেখাতে। দেখানো হয়নি। দুই দিন ছিলাম ব্যাংকক। সেই সময় পেলাম না। ব্যাংকক দিনে রাতে যানজটের এক শহর। অনেক ফ্লাইওভার হয়েছে। যানজট নিরসন হয়নি। স্কাই ট্রেন আছে দ্রুত চলাচলের জন্য। তাতে কিছুটা নিস্তার। তার পরও সকালে অফিস সময় এবং সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে সবাইকে ভয়াবহ যানজটে পড়তে হয়। এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইওভার ও স্কাই ট্রেনে যানজট শেষ হবে না। যানজট নিরসনে দরকার পাতালরেল। পাতালরেলে দুই মিনিট পরপর গাড়ি চলবে। মানুষ মুহূর্তে চলে যাবে গন্তব্যে। সমস্যা থাকবে না। সারা দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ত শহর নিউইয়র্ক ও লন্ডন। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে ২৪ ঘণ্টা মানুষের জট লেগে থাকে। রাত আর দিন নেই। তার পরও মানুষ চলছে পাতালরেলের কারণে। পাবলিক পরিবহন ছাড়া যানজট বন্ধ হয়। বাংলাদেশ পাতালরেলের ভাবনা মাথায় নিয়েছে। এটা খুবই পজিটিভ খবর। যানজট নিরসনে আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে কলকাতা। মানুষ ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলে। অকারণে হর্ন দেয় না। ভোররাতে রাস্তা খালি থাকলেও লালবাতি অতিক্রম করে না। অপেক্ষা করে। দিনের বেলায় পাতালরেল থাকায় ব্যস্ত শহর কলকাতার রক্ষা। এবার ব্যাংককে গিয়ে মনে পড়ল গৌতমকে। এ শহরে প্রথম এসেছিলাম গৌতমের সঙ্গে। কয়েক বছর আগে গৌতম ব্যাংককে মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। ব্যবসা করতেন। ব্যবসার কাজে গিয়েছিলেন। এক সকালে হাঁটতে বের হলেন। বেপরোয়া মোটরসাইকেল তাঁকে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তে ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। মানুষের মৃত্যু বলেকয়ে আসে না। হুট করে চলে আসে। তারপর নিয়ে যায় অজানার কাছে। আমরা আজ আছি কাল না-ও থাকতে পারি। ছোট্ট একটা জীবন দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়। গড় আয়ু ৭০ বছর হলে এখন অনেকে খুশি। এর বেশি বাঁচলে আল্লাহর নিয়ামত। ৭০ বছর বেঁচে থাকার ভাগ্যও সবার হয় না। লন্ডনের সানু মিয়া, পীর হাবিবুর রহমান হঠাৎ চলে গেলেন। একজন হৃদরোগে, আরেকজন ক্যান্সারে। পীর ক্যান্সার জয় করেছিলেন। চিকিৎসক তাঁকে বারবার বলেছিলেন করোনা থেকে দূরে থাকতে। করোনা হলে ইমিউনিটি শেষ হয়ে যায়। তখন অন্য রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। পীর চিকিৎসকের নিষেধ না শুনে গিয়েছিলেন বন্ধুদের আড্ডায় আমন্ত্রণে। করোনায় আক্রান্ত হলেন। হাসপাতালে ভর্তি হলেন। বিশ্বাস ছিল জীবনযোদ্ধা এবারও টিকে যাবেন। শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হলেন মৃত্যুর কাছে। বেঁচে থাকার আকুতি ছিল। করোনা নিয়ে গেল তাঁকে।
মানুষের জীবন ও মৃত্যু স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমরা এ স্বাভাবিকতা মানতে পারি না। ভাবতেও পারি না বেঁচে থাকার ভরসা এক সেকেন্ডও নেই। এবার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যু দুটোই দেখেছি। সুস্থ একটা মানুষ হাসপাতালে শরীরে বুকে ব্যথার কারণ পরীক্ষা করতে গেলাম। জানতে চাইলাম, গ্যাস্ট্রিক না হৃদরোগ বের কর। চিকিৎসক বললেন, তোমার হৃদরোগের সমস্যা মনে হয় না। তবে কয়েকটা পরীক্ষার পর সব জানা যাবে। পরীক্ষা করতে গিয়েই ধরা পড়ল সমস্যা স্টমাকে। চিকিৎসক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সার্জারি করলেন। তখন আমার হুঁশ ছিল না। নাকে ছিল অক্সিজেনের নল। মুখের ভিতর দিয়ে একটা পাইপ প্রবেশ করানো হলো, বুঝতেই পারলাম না। জানতে পারলাম না কী হচ্ছে আমার শরীর নিয়ে। এটাই চিকিৎসাবিজ্ঞান। আবার বাস্তবতার কাঠিন্য হলো, নাকের অক্সিজেনের নলটা কোনোভাবে খুলে নিলে বা খুলে দিলে জীবন থাকত না। দুনিয়ায় আরেকজন নেই-এর তালিকায় থাকত নাম। অ্যানেসথেসিয়া মুখে স্প্রে করে তারা বলেছিল গিলে ফেলতে। তাদের কথা শুনলাম। তারপর চলে গেলাম গভীর ঘুমে অথবা হলাম বেহুঁশ। কোনো কিছু আর আমাকে স্পর্শ করল না। আমার শরীরের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো। কোনো কিছু টের পেলাম না। জীবনের কোনো কিছু টের না পাওয়াটাই কি মৃত্যু?
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন । সূূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন